গল্প- বাংরেজবাবু

বাংরেজবাবু

-ইন্দ্রনীল মজুমদার

সে অনেকদিন আগের কথা, প্রায় একশ বছরের বা তারও বেশি হবে। আমরা তখন পরাধীন। গল্পটা এইরকমঃ-

ইংরেজ আমলে এক সাহেবদের স্কুলে কেরানির কাজ করতেন নকল সেন। তিনি বাঙালি হয়েও তাঁর মন পড়ে থাকত সাহেবি আদব-কায়দার দিকে৷ তা একদিন তাঁর মাথায় এক চিন্তার উদয় ঘটল, তিনি ভাবলেন যে তিনি ইংরেজ হবেন। ইংরেজরা অনেক নিয়ম-কানুন মানেন, তাঁরা অনেক ভদ্র। হাজার হোক আমাদের দেশটাকে তো চালাচ্ছেন। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। নকলবাবু ভাবলেন প্রথমে ভাষাটা বদলাতে হবে কারণ তাঁর মাতৃভাষা অতি জঘন্য। তাঁর জাতভাইরা অভদ্র, বদমাইস৷ বাঙালিদের মধ্যে ভালো কিছু কি আছে? এরা ‘বাপ-ঠাকুরদা’ করে মরে, পায়ের উপর পা তুলে ‘পরনিন্দা-পরচর্চা’ করে- এটা কি কোনো জাত হল? এইসব ভাবনা-চিন্তা করতে করতে নকলবাবু সিদ্ধান্ত নেন যে তাঁকে ইংরেজি আদব-কায়দা নকল করতে হবে। তা যাই হোক না কেন, একদিন এক মজার কাণ্ড ঘটল। সকালে প্রার্থনা করার সময় তিনি ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন-“stoodo up on the line”। তাঁর এই ইংরেজি শুনে ছেলেরা বেশ হাসাহাসি করল৷ হেডস্যার মিঃ এলিয়ট সাহেব চোখ রাঙিয়ে একবার তাকালেন নকলের দিকে। নকল ভাবলেন, এইতো ছেলেরা আমার ইংরেজি শুনে খুশি হল আর ইংরেজ সাহেব বুঝি আমার উপর হিংসা করল। অতএব পথ চলা শুরু হল, তিনি যেভাবেই হোক না কেন ইংরেজ হয়ে ওঠার চেষ্টা করলেন। ধুতি-পাঞ্জাবির বদলে কোর্ট-প্যান্ট পরলেন, মাথার মাঝখানে টাক তাই আশেপাশের চুলগুলিকে এমন করে আঁচড়ালেন যেন সাহেব দেখতে লাগে। সাহেবদের মতোন হ্যাট পরতেন এবং মাঝে মধ্যেই ইংরেজি বলেন।
অতএব তিনি এখন পুরোদস্তুর একজন ইংরেজ। বেঁটে ও মোটা চেহারায় ইংরেজ হিসেবে তাঁকে মানিয়েছে ভাল। আর হেঁটে স্কুলে যান না, যান ঘোড়ার গাড়ি করে। বাঙালিদের সাথে আর আড্ডা মারেন না তার বদলে তাঁর ইংরেজ বন্ধুদের সাথে মদ,উইস্কি খান এবং তাঁদের সাথে প্রতি শনিবার আনন্দ-ফুর্তি করেন। এত কিছু করে টাকা খরচা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তিনি পু্রো ইংরেজ হয়ে উঠছেন যে! নকলবাবুর আরও গুণ দেখা দিল যেমন তিনি দেষজ জিনিস গ্রহণ করতেন না। বিলিতি জিনিস তাঁর অতিপ্রিয়। দেশের বিপ্লবীদের ও তাঁদের কাজকর্মকে অপছন্দ করতেন। তাঁর মতে, “দেশ স্বাধীন হওয়া উচিৎ নয়। ইংরেজরা অনেক ভালো ও ইংরেজি ভাষা অনেক ভালো।” তখন প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, জগদীশ বোস গাছে প্রান খুঁজে পেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখালেখি করছেন, বাংলায় স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়েছে, দেশ ও দশের লোকে বাংলার গুণগান করছে। কিন্তু নকলবাবুর কাছে “এগুলো Rubbish-all are rubbish।” তাঁর মতে -ওখানকার লেখকরা যেমন Shakespeare, Dickens অনেক বড়ো লেখক এবং ইংরেজরা অন্যান্য ক্ষেত্রেও বাঙালিদের থেকে অনেক এগিযে। ইংল্যান্ডবাসীর কাছে বাঙালি কিছুই নয়। তা তিনি ইংরেজদের তৈলমর্দন করতেন, নিজেও ইংরেজ হয়ে তো উঠতেনই। তাঁর আচরণে তাঁর মাইনে বেড়েছে কিন্তু সম্মান বাড়েনি। তাঁর মতে তিনি একজন ইংরেজ এবং তাঁর মতো ইংরেজি কেউ জানে না। তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে ছেলেরা গেলে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত “এই জানিস ওখানে একজন ইংরেজ থাকেন আগে বাঙালি ছিল এখন ইংরেজ হযেছেন।” পাড়ার বউরা যারা তখনকার রীতি অনুযায়ী কম লেখাপড়া জানত তারাও বলাবলি করত, “এই জানিস ওই ভদ্রলোকের বাংলাটা এখন আর ঠিক আসে না। উনি আগে বাংলা বলতেন কিন্তু এখন সাহেবদের মতোন ইংরেজিতেই কথা বলেন। কারুর সাথে আর মেশেন না।” -এই বলে তারা দুহাত তুলে নকল-সাহেবের বাড়ির উদ্দেশে প্রণাম ঠুকত এই ভেবে যে তিনি ইংরেজ হয়ে উঠেছেন। তবে এসবে নকলসাহেবের কোনও মাথাব্যাথা নেই কারণ তাঁর মতে ‘বিবর্তন’-এর নিয়মে তিনি এখন ইংরেজ আগে হয়ত বাঙালি ছিলেন। তাঁর ইংরেজি আসল-সাহেবদের লজ্জা পাইয়ে দেয়। তা কোথা থেকে তিনি দুটো শব্দ শিখলেন ‘government’ ও ‘aided’। তিনি নিজের নাম রাখলেন ‘gov-aid’ তবে তিনি উচ্চারণ করতেন ‘গবেট’ (আসলে ইংরেজিটা তিনি বেশিই জানতেন)। তা এই ভাবেই কাটতে লাগল,একদিন এক কাণ্ড ঘটে বসল৷ স্কুলে আসলেন মিসেস হ্যামিলটন বলে এক উচ্চপদস্থ মহিলা, তিনি মিঃ এলিয়ট এর সাথে দেখা করতে চান স্কুলের ব্যাপারে কিছু কথা বলতে। তাঁর সঙ্গে দেখা হল নকলবাবুর সাথে, মেম বললেন- “Hi babu,Can you please tell me where the office of Mr.Elliot is?”

নকলবাবু নীচে দেখিয়ে বলেন বললেন, “You go to Hell.”(আসলে নকলবাবুর কাছে Hell-এর অন্য মানে আছে কারণ তিনি ইংরেজিটা ভালোই জানেন)
-What? Who are you?
-গবেট।
-Yes, I see.
– ট্যাংকে গু(আসলে Thank you)৷
-I see, let me complain against you……..

-শুয়োরলি(আসলে surely)।
(ইংরেজিটা ভালো জানার জন্যে তিনি সেদিন অনেক ঝামেলা ভোগ করেছিলেন। তাঁর চাকরি চলে গিয়েছিল ভালো ইংরেজি বলার জন্যে(অত্যন্ত তাঁর মতে)। কিন্তু শুনেছিলাম যে তিনি হাল ছাড়েননি, তিনি ইংরেজ হয়েই ছিলেন। বলাবাহুল্য তিনি হয়েছিলেন একজন ‘বাংরেজ’-অধিক ইংরেজি জানা বাঙালি৷ আমরা যেন সৌভাগ্যক্রমে তাঁর মতো যেন না হয়ে উঠি সবসময় যেন মনে রাখি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন। ইংরেজি শেখা ভালো কিন্তু বাংলা আমাদের মাতৃভাষা সেটা ভালোভাবে শেথা আগে দরকার।
“মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা৷”

জীবনে উন্নতি করতে গেলে মাতৃভাষাকে ভালোবাসা খুবই দরকার।)

Loading

2 thoughts on “গল্প- বাংরেজবাবু

Leave A Comment